প্রাচীন বাংলার হাবেলি দুর্গ ও রাজবাড়ি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রক্ষায় রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ জরুরি
- আপলোড সময় : ২৭-১০-২০২৫ ০৮:৩৯:৪৮ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ২৭-১০-২০২৫ ০৮:৩৯:৪৮ পূর্বাহ্ন
প্রাচীন বাংলার ইতিহাস কেবল পুঁথি-নথির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, তা ছড়িয়ে আছে দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা প্রতœতাত্ত্বিক নিদর্শনে। তাহিরপুর উপজেলার দুর্গম সীমান্তের হলহলিয়া ও ব্রাহ্মণগাঁওয়ের হাবেলি রাজবাড়ি ও দুর্গ সেই ইতিহাসেরই এক উজ্জ্বল সাক্ষী। পাল আমল থেকে সুলতানী যুগ হয়ে মোগল আমল পর্যন্ত যে ধারাবাহিক সভ্যতা এই অঞ্চলে বিকশিত হয়েছিল, তার জ্যোতির্ময় প্রমাণ এই স্থাপনাগুলো। অথচ আজ এই ঐতিহাসিক স্থাপনা ধ্বংস, দখল ও অবহেলার কারণে বিলুপ্তির পথে।
পদ্মনাথ ভট্টাচার্য্য বিদ্যাবিনোদ প্রায় একশ বছর আগে এই রাজবাড়ি পরিদর্শন করে লিখেছিলেন, “প্রায় তিনশত বৎসর হইল এইগুলি নির্ম্মিত হইয়াছে - তথাপি অনেকগুলি বিনাবলম্বনেও দাঁড়াইয়া রহিয়াছে।” শত বছর পরও এই শক্তপোক্ত স্থাপনা আমাদের ঐতিহ্যের দৃঢ় প্রতীক হয়ে আছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমরা কি আজও সেই ঐতিহ্য রক্ষায় সচেতন? উত্তর দুঃখজনকভাবে ‘না’।
২০১৮ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এই দুটি স্থাপনাকে গেজেটভুক্ত করলেও বাস্তবে এর সুরক্ষায় তেমন কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। সামান্য কিছু সংস্কারকাজের পরই উদাসীনতা, অনিয়ম ও দখলবাজদের তৎপরতা আবারও এই প্রত্নসম্পদকে গ্রাস করছে। স্থানীয় লোভী গোষ্ঠী “ছাত্র-জনতা” নাম ব্যবহার করে সরকারি অফিস ভেঙে, কাঁটাতারের বেড়া খুলে, এমনকি প্রত্নবস্তুও লুট করে নিয়ে গেছে, যা শুধু আইনি অপরাধ নয়, এটি জাতির সাংস্কৃতিক ইতিহাসের ওপর নির্মম আঘাত।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের অজুহাত ও স্থানীয় প্রশাসনের নীরবতা পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করেছে। সরকারের পরিবর্তনের পর প্রত্নসম্পদে হামলার ঘটনাও উদ্বেগজনক ইঙ্গিত দেয় - এ যেন রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাসও ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে। অথচ সংবিধান ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা অনুযায়ী, প্রতিটি গেজেটভুক্ত প্রত্নসম্পদ রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার আওতায় থাকা উচিত ছিল।
প্রাচীন এই লাউড় রাজ্যের কেন্দ্রস্থল ছিল যে দুর্গ ও রাজবাড়ি, তার প্রত্নতাত্ত্বিক মূল্য কেবল আঞ্চলিক নয়, জাতীয় পর্যায়েরও। এখানকার ধারাবাহিক খননে পাল ও সুলতানী আমলের সভ্যতার চিহ্ন, পোড়ামাটির নিদর্শন ও স্থাপত্য কাঠামো পাওয়া গেছে, যা গবেষণার জন্য অমূল্য সম্পদ। এই স্থাপনাগুলোর যথাযথ সংরক্ষণ হলে উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে প্রত্নপর্যটনের অন্যতম কেন্দ্র হিসেবেও গড়ে তোলা সম্ভব।
আজ দরকার রাষ্ট্রীয় আন্তরিকতা ও সমন্বিত পদক্ষেপ। প্রথমত, অবিলম্বে দখলকারীদের উচ্ছেদ করে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে এলাকাটিতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরি। তৃতীয়ত, প্রত্নতাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে দীর্ঘমেয়াদী খনন ও গবেষণার কর্মসূচি হাতে নিতে হবে। সর্বোপরি, স্থানীয় জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রত্নসম্পদের সংরক্ষণে অংশগ্রহণমূলক পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন।
হলহলিয়া ও ব্রাহ্মণগাঁওয়ের দুর্গ আজ শুধু একটি ভগ্ন স্থাপনা নয়; এটি আমাদের সভ্যতার স্মারক, আমাদের পরিচয়ের প্রতীক। ইতিহাসকে যারা ভুলে যায়, তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে মিলিয়ে যায় - এই সত্যটি আমাদের স্মরণে রাখতে হবে।
অতএব, এখনই রাষ্ট্রের উচিত এই ঐতিহ্যকে রক্ষায় দৃঢ় ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া, যাতে একদিন আমাদের সন্তানেরা গর্ব করে বলতে পারে, “আমাদের পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য আমরা সংরক্ষণ করেছি।”
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ

সম্পাদকীয়